একটি চারাগাছের কথা ধরা যাক, বীজ থেকে যখন চারাগাছটি জন্মায় তখন তা বেশ দুর্বল থাকে। এ সময়ে উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যার উপর গাছটির বেঁচে থাকা নির্ভর করে। একবার যদি গাছটির গোড়া মাটিতে শক্ত হয়ে যায় তবে পরবর্তীতে বিশেষ যত্ন ছাড়াই গাছটি বেড়ে উঠতে পারে। ঠিক তেমনি মানব শিশুর জীবনের প্রথম কয়েক বছরের যত্ন ও পরিচর্যা পরবর্তী জীবনের ভিত্তি তৈরি করে।
জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের প্রথম পাঁচ বছর একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে মূলভিত্তি রচনা করে। এ সময়ে দ্রুতগতিতে শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি তার আচরণগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এ সময়ের জন্য প্রয়োজন হয় শারীরিক যত্ন এবং পরিবারের বা তার চারপাশের ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, উষ্ণ সাড়া যা তাকে নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। যে শিশু জীবনের প্রথম বছরগুলোতে তার বিকাশের জন্য সহায়ক পরিবেশ পায় সে শিশুটি অন্যদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, সামাজিক ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। তার সামাজিক দক্ষতা, ভাষার দক্ষতা, সৃজনশীলতা, আত্মবিশ্বাস প্রভৃতির বিকাশ ঘটে যা পরবর্তী জীবনে তাকে সুখী ও সুন্দর থাকতে সহায়তা করে।
সকল পরিবারই তাদের শিশুদের ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের অনেকের মধ্যে শিশু প্রতিপালন বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা আছে বা কীভাবে তাকে সহায়ক পরিবেশ দিতে হবে এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা থাকে না। আমরা - অনেকেই জানি না যে, শিশুর সাথে খেলা ও ভাব বিনিময় শিশুর জীবনের প্রথম বছরগুলোতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর সাথে বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মা-ই হচ্ছেন প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বুকের দুধ খাওয়ানো এবং বিভিন্ন মাতৃ পরিচর্যা হলো শিশুর শরীর, মন ও আবেগ বিকাশের ক্ষেত্রে মায়ের শ্রেষ্ঠ অবদান ৷ সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, মা ও নবজাতকের মধ্যে জন্মের এক ঘণ্টা ও প্রথম কয়েক দিনের সান্নিধ্য উভয়ের মাঝে গভীর বন্ধন গড়ে তোলে, যা বিকশিত হতে থাকে এবং স্থায়ী হয় বছরের পর বছর। শিশুর সাথে বন্ধন তৈরির কয়েকটি পদক্ষেপ হলো-
শিশুকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের বুকের দুধ দেওয়া -
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে মায়ের জন্য সহায়ক পরিবেশের দরকার হয়। এই পরিবেশ তৈরিতে পরিবারের বাবার ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। তিনি বিভিন্নভাবে স্তন্যদানকারী মাকে সাহায্য করেন।
এ কাজগুলোর মধ্য দিয়ে বাবা পরোক্ষভাবে সন্তানের সাথে বন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখেন ।
শিশুর কান্নার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাড়া দেওয়া—
মাজের সাথে বার সহযোগিতা শিশুর জন্য মহারক পরিবেশ তৈরি কর
ভাষা বিকাশের আগে সাধারণত শিশুরা কান্না দিয়েই তাদের চাহিদা ও অসুবিধাগুলো প্রকাশ করে। অতি শৈশবের শিশু সাধারণত দুইটি কারণে কাঁদে। ক্ষুধার কারণে এবং যে কোনো ধরনের শারীরিক অসুবিধার
কারণে। ক্ষুধার শিশুকে খাবার দেওয়া এবং শারীরিক অসুবিধা দূর করার জন্য ব্যবস্থা করা যেমন- শিশুকে ভেজা বিছানায় না রাখা, মলমূত্র ঠিকমতো পরিষ্কার করা, পেট ব্যাথায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি কাজগুলো শিশুকে আরাম দেয়। শিশু যদি আরামে ঘুমাতে পারে, কান্নার যত তাড়াতাড়ি মা-বাবার সাড়া পায়, তাকে কোলে তুলে নেওয়া হয়, তাহলে মা-বাবার প্রতি শিশুর বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিপরীতে যখন শিশুর অসুবিধাগুলো সময়মতো দূর করা হয় না অথবা শিশু কোনো কারণে আরাম পায় না তখন তার মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থার অনুভূতি জন্মাতে থাকে। বাবা-মায়ের আদর, যত্ন, স্নেহ ভালোবাসার অভাবে একটি শিশুর মা-বাবার প্রতি অনাস্থার পাশাপাশি পরিবেশ সম্পর্কেও শিশুটির মধ্যে অনাস্থা ও নিরাপত্তাহীনতা এবং হতাশার জন্ম নেয়। সেক্ষেত্রে শিশু বেশি কান্নাকাটি করে।
শিশুকে কাছে নিয়ে ঘুমানো-
দিনের বেলার মতো রাতেও শিশুর বিভিন্ন ধরনের চাহিদা পূরণ করতে হয়। রাতে মা-বাবা শিশুকে ঘুম পারিয়ে দেওয়া এই চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর শিশুকে কাছে নিয়ে ঘুমানো জরুরি। এতে মা রাতে শিশুর চাহিদা ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং মায়ের দুধ খাওয়ানো সহজ হয়। এ ছাড়া রাতে শিশুর আশপাশে মা-বাবার উপস্থিতি শিশুর জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে। বিছানায় যাওয়ার আগে প্রত্যেক শিশু মা-বাবাকে কাছে পেতে চায়। স্কুলে যাওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। কখনো বড় শিশুরাও তাদের সারা দিনের কর্মকান্ড ঘুমানোর আগে মা-বাবাকে বলতে পছন্দ করে।
শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া-
শিশুরা সাধারণত খাদ্য ও নানা ধরনের শরীর বৃত্তীয় কাজে মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। এসব কাজে বাবারও সহায়ক ভূমিকা থাকলে শিশুর মায়ের উপর নির্ভরশীলতা কমে এবং বাবার সাথে তার আসক্তি তৈরি হয়।
শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিতে করণীয়-
এ ছাড়া জীবনের প্রথম বছরগুলোতে শিশুকে বেশি কাছে রাখা, শারীরিক সংস্পর্শ, শিশুকে আদর, স্নেহ করা, বিষয়গুলো শিশুর সাথে মা-বাবার বন্ধনকে মজবুত করে। শৈশবে মা-বাবা শিশুকে যত বেশি সময় দেবে এবং স্নেহ করবে তাদের বন্ধন ততই দৃঢ় হবে এবং এ বন্ধন তাদের পরবর্তী বয়সে মা-বাবার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
কাজ : শিশুকে মায়ের দুধ দেওয়া- শিশুর সাথে মায়ের বন্ধন তৈরির শ্রেষ্ঠ সূচনা” – বিষয়টির উপর - একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
শিশুকে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা পরিবারের অন্যতম একটি কাজ। জন্ম গ্রহণের পর শিশুর সাথে পরিবারের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে। ৭/৮ মাস বয়সের মধ্যে শিশুরা মা-বাবা কিংবা যারা তাদের যত্ন নেয় তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। এ বয়সের কোনো শিশুকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা তাদের মা- বাবার মনোযোগ পাওয়ার জন্য বিশেষ চেষ্টা করে। যখন মা শিশুর ঘরে প্রবেশ করে তখন শিশু খুশি হয়ে উঠে। মা তাকে কোলে তুলে নিলে সে তার মুখে হাত দেয়, চুল নাড়াচাড়া করে। শিশু ভয় পেলে মায়ের কোলে আশ্রয় নেয়। জন্মগ্রহণের পরপরই শিশুর সাথে মায়ের সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। মায়ের কোমল স্পর্শ, স্নেহ, হাসি, ভালোবাসা সবই শিশুর সাথে তার গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে।
গবেষকরা দেখেছেন বাবার সাথে শিশুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শিশুর ইতিবাচক বিকাশে ভুমিকা রাখে। শিশুর লালন- পালনে বাবার অংশগ্রহণ মায়ের তুলনায় কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং কখনো কখনো শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশে মায়ের চেয়েও বেশি শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। যে পরিবারে বাবা শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দেন, শিশু লালন পালনে স্নেহপূর্ণ অংশ নেন সে পরিবারের শিশুর মধ্যে বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা কম দেখা যায়। এমনকি বাবার অংশগ্রহণ, শিশুর কৈশোরের মাদকাসক্তি বা অপরাধমূলক কাজ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
শুধুমাত্র সন্তানের সাথে মা-বাবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করলেই হবে না, মা-বাবার নিজেদের মধ্যেও স্বামী- স্ত্রী হিসাবে সম্পর্ক সুখের হতে হবে। কারণ সুখী মা-বাবার সন্তানেরাও সুখী থাকে। মা-বাবার সান্নিধ্যে শিশুরা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করে এবং আনন্দ পায়। তাই মা-বাবার মধ্যে যখন সুসম্পর্কের অভাব থাকে তখন শিশু প্রতিপালনে তাদের মনোযোগ থাকে না। ফলে শিশুটির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি শিশুকে পর্যাপ্ত খাদ্য দেওয়া হলেও যদি তার যথাযথ পরিচর্যা না করা হয়, তবে পর্যাপ্ত ভালোবাসা, মনোযোগ, ও উদ্দীপনা পাওয়া অপর একটি শিশুর তুলনায় তার মস্তিষ্কের বিকাশ কম হয়
ভাই-বোনের সাথে পারস্পরিক শিথিল সম্পর্ক একটি শিশুর আত্মধারণাকে বিঘ্নিত করে। ভাই-বোন শিশুটিকে যেভাবে মূল্যায়ন করে অর্থাৎ ভালো বা মন্দ বলে, নিজের প্রতি শিশুটির সে ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়। বড় ভাই বোনকে অনুসরণ করে শিশু ভালো বা খারাপ আচরণ শেখে। ভাই-বোনের সান্নিধ্যে শিশু নিরাপত্তা পায়। আবার ভবিষ্যৎ জীবনে দলগতভাবে মেলামেশার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। মা-বাবার পাশাপাশি পরিবারে ভাই-বোনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজন। পরিবারে ভাই-বোনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকলে উভয়েরই সাহচর্যে তাদের সময় আনন্দময় হয়ে উঠে।
শিশুর ভাই বা বোন হিসেবে যে সব আচরণ শিশুর সাথে
ভালো সম্পর্ক তৈরি এবং শিশুর বিকাশে সহায়তা করে ছোট ভাই বা বোনের যত্নে সহযোগিতা করা
কোনো জিনিস ভাগাভাগি করা
পরস্পরকে সাহায্য করা
- তাদের সঙ্গ দেওয়া, খেলাধুলা করা সবাই মিলেমিশে থাকা
তাদের সাথে স্নেহের সম্পর্ক তৈরি করা
যে আচরণ পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়নে ক্ষতিকর হয়
এবং শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে
ছোট ভাই বা বোনকে সঙ্গ বা সময় না দেওয়া
নিজের স্বার্থ বড় করে দেখা
ঈর্ষা করা
- ভাই-বোনের সাহচর্য এড়িয়ে চলা
ঝগড়া করা, মারামারি করা
অবহেলা করা, নিজেকে বড় মনে করা
আমাদের দেশে যৌথ পরিবার প্রথায় একটি পরিবারে আরও অনেক সদস্য থাকেন, যারা শিশুর লালন-পালনে বাবা-মাকে সহযোগিতা করে থাকেন। বিশেষ করে কর্মজীবী মায়ের ক্ষেত্রে শিশুর যত্নে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভূমিকা থাকে অনেক বেশি। শিশুর প্রতি আত্মীয়স্বজনের মনোভাব এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়। যখন কেউ মনে করে যে শিশুটিকে শুধুমাত্র পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। শিশুর কথা শোনা, তার সাথে খেলা করার প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রে শিশুর সাথে সেই সদস্যের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে না ।
পরিবারে ভাই-বোনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকলে উভয়েরই সাহচর্যে তাদের সময় আনন্দময় হয়ে উঠে। পরিবারে দাদা-দাদি, নানা-নানি শিশুর সাথে গল্প করেন, শিশুদের তাদের নিজের জীবনের অনেক ঘটনা শোনান। তাঁরা শিশুর অসুবিধার কথা শোনেন, তা সমাধানের চেষ্টা করেন। শিশুকে আদর-ভালোবাসা দেন ৷ এভাবে শিশুর সাথে পরিবারের সকলের ভাব বিনিময় শিশুর প্রথম বছরগুলোর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর চারপাশের মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময় ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। শৈশবে যদি পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয় ভবিষ্যতেও শিশু তার মা-বাবা, ভাই- বোন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে বন্ধু হিসেবে ভাবতে শেখে ৷
কাজ ১ পরিবারের ভাই-বোনের সম্পর্ক উন্নয়নের কয়েকটি উপায় লেখ ।
কাজ ২ - পরিবারের আর্থিক সংকটে তোমার করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ কর ।
পারিবারিক বিপর্যয়-
প্রতিটি শিশুর জন্যই প্রয়োজন হয় পরিবারের যেখানে সে আদর, ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও বিশ্বাস পায়, সুরক্ষিত থাকে এবং তার মৌলিক চাহিদাকে পূরণ করা হয়। পরিবার এমন একটি সংগঠন যেখানে স্বামী-স্ত্রী একসাথে অবস্থান করেন। শিশুকে লালন পালন এবং শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব থাকে পরিবারের উপর।
শিশু পরিবারে জন্ম নেয় এবং বড় হয়ে উপার্জন করতে শেখে। এই দীর্ঘ সময়ে পরিবার অনেক ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। পারিবারিক এই বিপর্যয়ের মধ্যে আছে- মা কিংবা বাবার অসুস্থতা, মৃত্যুজনিত শূন্যতা, মা-বাবার পৃথক অবস্থান কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদ। এ ছাড়াও আছে বাবা-মায়ের সার্বক্ষণিক ঝগড়া, মতের অমিল, পরস্পরের সমঝোতার অভাব, পরিবারে বাবার অনুপস্থিতি বা চাকরি চলে যাওয়া, ব্যবসায় ক্ষতি, মায়ের উপর দৈহিক নির্যাতন ইত্যাদি। পারিবারিক বিপর্যয় যে ধরনেরই হোক না কেন, তা পরিবারের সদস্যদের কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এতে শিশু জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত হয়।
বাবা/মায়ের মৃত্যু— পরিবারে বাবা কিংবা মায়ের মৃত্যুতে পরিবারে শিশুর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। সাধারণত পরিবারে বাবা উপার্জন করেন। এ কারণে বাবার মৃত্যুতে পরিবারে আর্থিক সংকট প্রকট হয়। পরিবারে বিভিন্ন বয়সের শিশু থাকলে তাদের ভরন-পোষণ, লেখাপড়ার খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। মায়ের মৃত্যুতে সন্তানেরা দিশেহারা হয়। তাদের দেখাশোনা, যত্ন পরিচর্যায় অবহেলা হয়। বাবা কিংবা মা যে কোনো একজনের মৃত্যুতেই সন্তান স্নেহবঞ্চিত হয় ।
বাবা/মায়ের গুরুতর অসুস্থতা- পরিবারে মা বা বাবার হঠাৎ কোনো গুরুতর অসুস্থতা ধরা পড়লে পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। মা কিংবা বাবার দীর্ঘ দিনের অসুস্থতা পরিবারে সংকট সৃষ্টি করে। হঠাৎ কোনো গুরুতর অসুস্থতায় বা দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া মা-বাবার সুস্থ সঙ্গ থেকে শিশুরা বঞ্চিত হয়। মা-বাবার অসুস্থতায় তারা মা-বাবাকে হারানোর ভয়ে ভীত, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মা-বাবা ছাড়াও পরিবারের যে কোনো সদস্যের গুরুতর অসুস্থতা পারিবারিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
পরিবারে ভাঙ্গন- স্বামী- স্ত্রীর মতের অমিল, পরস্পরের সমঝোতার অভাব, দ্বিতীয় বিয়ে ইত্যাদি পারিবারিক ভাঙ্গনের অন্যতম কারণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্তানেরা ছোট অবস্থায় পারিবারে ভাঙ্গনের আশঙ্কা বেশি থাকে। মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ বা পৃথকভাবে অবস্থান ছেলে-মেয়েদের মনে হতাশা, দ্বন্দ, পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব প্রভৃতি মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। পরিবারে ছোট শিশু থাকলে তাকে যদি বাবার কাছে থাকতে হয় তবে মায়ের স্নেহ বঞ্চিত হয়ে তার বিকাশে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে পরিবারের ভাঙ্গনে তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। স্কুলগামী শিশুরা বন্ধুবান্ধবদের বিরূপ মন্তব্যে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অনেক সময়ে বিভিন্ন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যাতে পড়তে না হয় সেজন্য সন্তানেরা কোথাও বের হতে চায় না, সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়, তারা অন্তর্মুখী হয়। তাদের মনের কষ্ট অনেক সময় শারীরিক কষ্টে রূপ নিতে পারে। যেমন- মাথাব্যথা, খাবারে অনীহা, ঘুমের ব্যঘাত ইত্যাদি ৷
পারিবারিক বিপর্যয়ে পরিবারের সদস্যরা একত্র হয়ে সংকট মোকাবিলা করলে সমস্যা অনেক কমে যায়। পারিবারিক বিপর্যয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয় আর্থিক সংকট। পরিবারের আর্থিক সমস্যা
দূর করতে এবং ছোট শিশুদের বিকাশজনিত চাহিদা পূরণে পরিবারের কিশোর বয়সের সন্তানেরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিতে পারে। তারা যা যা করতে পারে –
কাজ- তোমার জানা কোনো পরিবারের যে কোনো বিপর্যয়ে তারা যে ধরনের সমস্যার সন্মুখীন হয়েছে— তা লেখ। ওই পরিবারটির সহায়তায় তোমার করণীয় কী তা উল্লেখ কর ।
অনেক শিশুবিজ্ঞানী জন্মের মুহূর্তে শিশুকে সাদা কাগজের সাথে তুলনা করেছেন। সাদা কাগজে যেভাবে একটি ছবি আঁকা হয় ছবিটি সেভাবেই রূপ লাভ করে। ঠিক তেমনি নবজাত শিশুর জীবনে কোনো অভিজ্ঞতা থাকে না। সে তার চারপাশের পরিবেশ থেকে যে ধরনের অভিজ্ঞতা পায় সেভাবেই আচরণ করতে শেখে। সুষ্ঠু পরিচালনার মাধ্যমে যেমন একটি শিশুকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলা যায় ঠিক তেমনি সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে শিশুর মধ্যে অনেক ধরনের আচরণগত সমস্যা তৈরি হতে পারে যা তার বর্তমান বিকাশকে এবং পরবর্তী বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। শিশুরা কাদা মাটির মতো। সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে শিশুটিকে মনমতো ছাঁচে গড়ে তোলা যায়, শিশুর সামর্থ্য বাড়ানো যায়। সেজন্যে শিশু পরিচালনার নীতি আমাদের জানা জরুরি।
শিশু পরিচালনার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নীতি -
১. ‘টেবিলে কাঠের টুকরা রেখ না' না বলে বলতে হবে ‘কাঠের টুকরাগুলো মাটিতে রাখ।
২. এখন খেলার সময় নয়— না বলে বলতে হবে ‘এখন খেয়ে নাও পরে খেলবে'।
৩. মুখ ধুতে এত বেশি সময় নষ্ট করো না- না বলে বলতে হবে ‘তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে নাও'।
৪. তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না- না বলে বলতে হবে ‘চেষ্টা করলেই তুমি পারবে'।
ইতিবাচক নির্দেশ নেতিবাচক নির্দেশ অপেক্ষা কম প্রতিবাদ আনে, এতে কাজ ভালো হয়। বড়দের ইতিবাচক উক্তি, মন্তব্য শিশুকে নিজের প্রতি আস্থাশীল করে তোলে। সে সফল হওয়ার চেষ্টা চালায়। তাকে কাজ করতে উৎসাহিত করে।
স— স্বীকৃতি A- Acceptance
স- স্নেহ A- Affection
স- সাফল্য A- Achievement
স্বীকৃতি- সকল শিশুর চেহারা বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি একরকম হয় না। কেউ যদি দেখতে সুন্দর হয় তবে সকলে তাকে সাদরে গ্রহণ করে। এখানে স্বীকৃতি অর্থ শিশু যেভাবে আছে সেভাবেই তাকে গ্রহণ করা বোঝায়। শিশুটি দেখতে ভালো বা খারাপ, পঙ্গু বা স্বাভাবিক, বুদ্ধি কম বা বেশি, ছেলে বা মেয়ে যে অবস্থায় থাকুক তাকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। শিশুটি যেমন ঠিক তেমনভাবে তাকে গ্রহণ করা, তার গুণাবলিকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সেভাবে উৎসাহ দিলে শিশু সুখী থাকে।
স্নেহ- প্রত্যেক শিশুর মধ্যে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার চাহিদা থাকে। শিশুর যত্ন, পরিচর্যা, তাকে সময় দেওয়া, কিছু শেখানো ইত্যাদি সবকিছুই যদি আদরের সাথে হয়, তাহলে শিশুর মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তার অনুভূতি আসে। তখন সে তার পরিবেশকে ভয় পায় না ।
সাফল্য- প্রত্যেক শিশু সফলতা চায়। সে কোনো কাজ পারলে খুশি হয়। এ জন্য শিশুর ভালো কাজ বা কাজের ভালো দিকগুলো তুলে ধরা হলে সে নিজের শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে পারে বা বুঝতে পারে যে সে কি পারে। এই উৎসাহ তাকে সফলতার অভিজ্ঞতা দেয় এবং শিশুটি পরিতৃপ্ত ও সুখী থাকে ।
কাজ ১- . শিশুর বিকাশে প্রশংসা ও শাস্তির ফলাফলের তালিকা কর ।
কাজ ২- কয়েকটি নেতিবাচক বাক্য ইতিবাচক ভাবে রূপান্তর কর। ক্লাসে তা পড়ে শোনাও